হাদিসের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। এ কারণেই কুরআনের ন্যায় হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
মোটকথা একজন মুসলমানের জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ, তালাক, ইবাদাত-বন্দেগি, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার, লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, যুদ্ধ-সন্ধি, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক সমস্ত বিষয়ের বিস্তারিত নির্দেশনা আমরা রাসুলের হাদিসের মাধ্যমে লাভ করতে পারি। এজন্য আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'রাসুল তোমাদের যা দেন, তা তোমরা গ্রহণ কর, এবং যা তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।' (সুরা হাশর, আয়াত: ৭)
মহান আল্লাহর ক্ষমা ও ভালোবাসা লাভের জন্য রাসুলের কথা-কাজ ও আদর্শের আনুগত্য করা একান্ত জরুরি। কেননা রাসুলের আনুগত্য মহান আল্লাহর অনুগত্যের নামান্তর। এতে আল্লাহ খুশি হন। আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন, তাকে ক্ষমা করে দেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, 'বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, এতে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করবেন।' (সুরা আলে ইমরান: ৩১)
হাদিস মহানবি (সা.) এর জীবনাদর্শকেই সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলে। তাই মহানবি (সা.) এর জীবনাদর্শের খুঁটি-নাটি জানতে হাদিসের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আর রাসুল (সা.) এর অনুকরণ ও অনুসরণ করতে হলে হাদিসের বিকল্প নেই। অন্য দিকে রাসুলের আনুগত্য ও অনুসরণের অর্থই হলো মহান আল্লাহর আনুগত্য করা। হাদিসের অনুসরণের মাঝেই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য নিহিত। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, 'যে রাসুলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল।' (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ৮০১
আল-কুরআন সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রধান উৎস। আর দ্বিতীয় উৎস হলো হাদিস। হাদিস কেবল রাসুল (সা.)- এর কথা ও কাজের বর্ণনা তা নয়, এটা তাঁর প্রদত্ত শিক্ষা ও জ্ঞানের সমষ্টি। তিনি ছিলেন মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। মহান আল্লাহ তাঁকেই সবচেয়ে বেশি জ্ঞান দান করেছেন। সেই জ্ঞান আমরা হাদিস শাস্ত্রেই খুঁজে পাই। পথিবীতে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (সা.) প্রদর্শিত হিদায়েতের উপর অটল ও অবিচল থাকতে হলে হাদিসের অনুসরণ করতে হবে। মহানবি (সা.) নিজে হাদিসের প্রয়োজনীয়তার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন,
ترَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَن تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ رَسُوْلِهِ
অর্থ: 'আমি তোমাদের মাঝে দু'টি বন্ধু রেখে যাচ্ছি, তোমরা যতদিন এগুলোকে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব (কুরআন) এবং অপরটি হচ্ছে তাঁর রাসুলের সুন্নাহ।' (মুয়াত্তা) বস্তুত কুরআন ও হাদিস ইসলামি শরিয়তের প্রধান দু'টি উৎস। কুরআনের প্রতিটি আয়াত ও নির্দেশ যেমন মানুষকে সত্য ও সৎপথের সন্ধান দেয়, তেমনি হাদিসও সমস্ত মানবজাতিকে ন্যায় এবং শান্তির পথে পরিচালিত করে। তাইতো মহানবি (সা.) বিদায় হজের ভাষণে মুসলিম জাতিকে লক্ষ্য করে নির্দেশ দেন- 'যারা এখানে উপস্থিত, তাদের দায়িত্ব হলো, যারা অনুপস্থিত তাদের কাছে আমার বাণী পৌঁছে দেওয়া।' (বুখারি)
উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, মানবজীবনে মহানবি (সা.) এর হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। হাদিসকে অস্বীকার করা কিংবা অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং আমরা মহানবি (সা.)- এর হাদিস অনুযায়ী আমল করবো এবং নিজেদের জীবন হাদিসের আলোকে সাজাবো।
কাজ: শিক্ষার্থীরা হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একটি অনুচ্ছেদ বাড়ির খাতায় লিখে আনবে |
চরিত্র গঠন ও মুনাজাতমূলক হাদিস
চরিত্র গঠনমূলক দু'টি হাদিস
প্রিয় শিক্ষার্থী। তোমরা জান যে, চরিত্র মানবজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। পৃথিবীর সকল নবি-রাসুলকে প্রেরণ করা হয়েছিল মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনের জন্য। এমনকি মহানবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কেও উত্তম চরিত্রের শিক্ষাদানের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। মহানবি (সা.) বলেন, আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য প্রেরিত হয়েছি। তাই আমাদেরকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। অন্যদিকে মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা ও মুনাজাত করে মানব জাতি বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে। আল্লাহর অফুরন্ত কল্যাণ লাভেও ধন্য হতে পারে। তাছাড়া মুনাজাতের মাধ্যমে বান্দা তার গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে থাকে। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) -এর অসংখ্য হাদিস রয়েছে। তাহলে চলো আজ আমরা উন্নত চরিত্র গঠন ও মুনাজাতমূলক হাদিস শিখবো।
হাদিস- ১
خَيْرُ النَّاسِ أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ
অর্থ: 'সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ সেই ব্যক্তি, যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী।' (ইবনু হিব্বান)
ব্যাখ্যা ও শিক্ষা: পরোপকার মানব চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তম পূণ। মহান আল্লাহ পরোপকারীকে ভালোবাসেন। মহানবি (সা.) নিজে পরোপকারী ছিলেন এবং উম্মতকে অন্যের উপকার করার জন্য উৎসাহ দিতেন। আলোচ্য হাদিসে মহানবি (সা.) মানুষকে অন্য মানুষের প্রতি সদয় হতে, বিপদে-আপদে সর্বাবস্থায় উপকার করতে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তবে এখানে কেবল পার্থিব বা বস্তুগত উপকার উদ্দেশ্য নয়; বরং দুনিয়া ও আখিরাতে যত রকমভাবে মানুষকে উপকার করা যায়, সবই এই হাদিস এর উদ্দেশ্য। দুনিয়ায় একজন মানুষকে নানাভাবে উপকার করা যায়। যেমন অভাবীকে অর্থ দিয়ে, রোগীর সেবা করে ও বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করে। অনুরূপভাবে আখিরাতের দৃষ্টিকোণ থেকেও একজন মানুষকে উপকার করা যায়। এই উপকার পার্থিব উপকারের চেয়েও মহান। যেমন পথভ্রষ্ট কাউকে সঠিক পথ দেখানো, আল্লাহর পরিচয় জানানো, সঠিক জ্ঞান দান করা, ভালো মানুষ হতে উদ্বুদ্ধ করা ইআদি।
আল্লাহ তা'আলা আমাদের কল্যাণ চান। তাই তিনি যখন দেখেন আমরা তাঁর অপর বান্দার উপকার করছি, তখন তিনি খুবই খুশি হন। পরোপকারীর যাবতীয় প্রয়োজন তিনি নিজেই তখন পূর্ণ করে দেন। পরোপকারকারীকে সর্বোত্তম মানুষদের কাতারে নিয়ে আসেন।
সুতরাং আমরা সবসময় আমাদের সাধ্যমতো অন্যের উপকার করব। কখনও কারো ক্ষতি করব না। তাহলেই আমরা মহান আল্লাহর দরবারে সর্বোত্তম মানুষ হিসেবে পরিগণিত হতে পারব।
হাদিস- ২
الْمُسْلِمُ مَن سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِن لِسَانِهِ وَيَدِهِ
অর্থ: 'প্রকৃত মুসলিম সে-ই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে।' (বুখারি)
ব্যাখ্যা ও শিক্ষা: মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। বিপদে-আপদে একে অপরকে সাহায্য করবে। তার জান-মাল ও মান-সম্মান হেফাযত করবে। শত্রুর কবল থেকে তাকে রক্ষা করবে। কখনও বিপদের মুখে ঠেলে দিবে না। কোনো ক্ষতি করবে না ও অকল্যান কামনা করবে না।
মানুষ দুইভাবে অপরের ক্ষতি করতে পারে। কথা দিয়ে এবং সরাসরি শক্তি প্রয়োগ করে। এই হাদিসের শিক্ষা হলো, একজন প্রকৃত মুসলিম কখনও কোনোভাবে অপরের ক্ষতি করতে পারে না। কারণ অপরের ক্ষতি করা ইসলামের শিক্ষা নয়।
মুখ দিয়ে অপরকে গালিগালাজ করা যায়, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া যায়, পশ্চাতে নিন্দা করা যায়। সর্বোপরি মিথ্যা বলে কারো সম্মানহানি করা যায়। সবগুলো কাজই চরম নিন্দনীয় ও ইসলামি আদর্শের বিপরীত। অন্যদিকে হাত বা বল প্রয়োগ করে অপরকে মারধর করা থেকে শুরু করে তার জীবন পর্যন্ত বিনষ্ট করা যায়। অথচ অপরকে বিনা কারণে আঘাত করা হারাম। যে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে, সে জাহান্নামি হবে। তাই আমরা কখনও মুখে যেমন কারও ব্যাপারে খারাপ কথা বলবো না, তেমনি কারও বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে শক্তি প্রয়োগ করবো না। আমরা একে অপরের প্রতি সহনশীল হবো। ক্ষমাশীল হবো। তাহলেই আমরা প্রকৃত মুসলিম হতে পারবো।
মুনাজাতমূলক দু'টি হাদিস
মহান আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক। তিনি মহানবি (সা.)-কে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন। তাই তিনি সর্বদা সৃষ্টিজগতের কল্যান কামনা করতেন। মানুষের জন্য কল্যাণকর কাজ ও পথ দেখিয়ে দিতেন। তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে মহান আল্লাহর অফুরান নিয়ামত লাভের জন্য আমাদেরকে মুনাজাতের শিক্ষা দিয়েছেন। মহানবি (সা.)-এর অসংখ্য মুনাজাতমূলক হাদিস রয়েছে। আজকের পাঠে আমরা মহানবি (সা.)- এর মুনাজাতমূলক দু'টি হাদিস শিখব।
হাদিস- ১
اللهم إني أسألُكَ الصِّحْةَ، وَالْعِفَّةَ، وَالْأَمَانَةَ
وَحُسْنَ الْخَلْقِ ، وَالرِّضَى بِالْقَدْرِ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাস-সিজ্জাতা ওয়াল 'ইজ্জাতা ওয়াল আমানাতা ওয়া হুসনাল-খুলুকি ওয়ার- রিদা বিল-কাদরি।
অর্থ: হে আল্লাহ। আমি আপনার কাছে সুস্বাস্থ্য, পবিত্রতা, আমানতদারি, উত্তম চরিত্র এবং তাকদিরের উপর সন্তুষ্ট থাকার মানসিকতা প্রার্থনা করছি। (বায়হাকী)
উপরোক্ত হাদিস দু'টি গুরুত্বপূর্ণ মুনাজাতমূলক হাদিস। প্রথম হাদিসে মুনাফিকি, রিয়া, মিথ্যা, খিয়ানাত হতে রক্ষার এবং ২য় হাদিসে সুস্বাস্থ্য, পবিত্রতা, আমানতদারি, উত্তম চরিত্র এবং তাকদিরের উপর বিশ্বাস রাখার ব্যাপারে প্রার্থনা শিখানো হয়েছে। আমরা অর্থসহ হাদিস দু'টি শিখব। এগুলোর মাধমে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করব। তাহলে আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে কল্যাণ দান করবেন।
প্রতিফলন ডায়েরি লিখন | ||
সুরা/হাদিসের নাম | সুরা/হাদিস থেকে যে শিক্ষা পাই | বাস্তবজীবনে যেভাবে চর্চা করবো |
সুরা আল মাউন | আশে-পাশের মানুষকে দেখানোর জন্য সালাত আদায় করা যাবে না | নিয়মিত যথাসময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় সালাত আদায় করবো। |
আরও দেখুন...